মাসিক সচেতনতা থেকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার – মাসিক স্বাস্থ্যকে নারীর মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে নিশ্চিতকরণে সংলাপের আহ্বান
‘১৯৮০ সালের কথা। আমার খালাতো বোনের প্রথম মাসিক হয়েছে। খালা খালুকে বললেন, তোমার মেয়ের শরীর খারাপ করেছে। খালু শুনে বাজার থেকে প্যাড আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। খালার কাছে প্যাডটা দিয়ে বললেন, এটা মেয়ের ব্যবস্থাপনার জন্য। খালা জিজ্ঞেস করলেন, মিষ্টি কিসের জন্য? খালু বললেন, এই মিষ্টি তুমি সবাইকে বিলিয়ে বল যে আমার মেয়ের মাসিক হয়েছে। খালার প্রতিক্রিয়া ছিল, এ রকম একটা শরমের বিষয় আমি কীভাবে মানুষকে বলব? খালু বললেন, “আমি তো আজকে আশ্বস্ত হলাম যে আমার মেয়েটা স্বাভাবিক।”
একটি সমাজ কতটা মানবিক—তা বুঝার অন্যতম উপায় হচ্ছে সেই সমাজ তার নারীদের প্রতি কতটা সংবেদনশী তার মাধ্যমে। আর নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সেই মানবিকতার একটি মৌলিক সূচক। ‘মাসিকবান্ধব বিশ্বের জন্য একতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এমন এক বাস্তবতা উঠে এসেছে, যেখানে নারীর স্বাস্থ্যের অধিকারের সঙ্গে সামাজিক লজ্জা, নীরবতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। বরং পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. মনজুর হোসাইন-এর বলা উপরের স্মৃতিচারণটা একটি ব্যাতিক্রম, অথচ এটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল।
গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করে দৈনিক আজকের পত্রিকা তাদের মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস উদযাপন উপলক্ষে। এর সহযোগিতায় ছিল পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি) ও ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (আইপিপিএফ)। বৈঠকে বক্তারা মাসিক নিয়ে দীর্ঘদিনের সামাজিক কুসংস্কার, নীরবতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে সরব হন এবং নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।
পিএসটিসির টিম লিডার অনিতা শরীফ চৌধুরী তার উপস্থাপনায় বলেন, দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ নারী এখনো মাসিক নিয়ে মুখ খোলেন না। এ নীরবতা শুধু একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার প্রতি নয়, নারীর আত্মমর্যাদা ও স্বাস্থ্যগত অধিকারের প্রতিও অবজ্ঞা। বিশেষত প্রান্তিক নারী, প্রতিবন্ধী, বস্তিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের জন্য মাসিক এখনো বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে।
সভায় উঠে আসে নারীবান্ধব টয়লেটের অভাব, স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্য, এবং পরিবেশসম্মত ডিসপোজাল ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বক্তারা বলেন, মাসিককে কেন্দ্র করে যে লজ্জা ও ভীতি তৈরি করা হয়, তা কিশোরীদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে, এমনকি তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত করে। মাসিকের দিনগুলোতে স্কুলে যাওয়া, খেলা বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অনেকের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখার সময় রেডঅরেঞ্জ কমিউনিকেশনসের হেলথ কমিউনিকেশন ডিরেক্টর ডা. ফারহানা হক বলেন, মাসিকের বিষয়টাকে কিশোরীদের কাছে এমনভাবে ভয়াবহ করে তোলা হয় যে তারা আতঙ্কিত হয়ে যায়।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এমডিএফের বাংলাদেশ কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক মাহবুবা হক কুমকুম ব্যবহৃত স্যানিট্যারি প্যাড নষ্ট করার (ডিসপোজাল) সমস্যাটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশেষ করে বন্যার সময় কেমন হবে, স্কুল-কলেজে কীভাবে হবে। গ্রাম বা প্রান্তিক অঞ্চলে আরও সমস্যা।
পিএসটিসির প্রজেক্ট ম্যানেজার কানিজ গোফরানি কুরাইশি বলেন, একই দিন (২৮ মে) নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এ বিষয়টাও মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। মাসিকের ব্যবস্থাপনা যদি সঠিক না হয়, মাতৃত্ব তখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়।
বক্তারা বলেন, শুধু গবেষণা বা সভা নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বন্যা বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীদের জন্য মাসিককেন্দ্রিক সহায়তা প্যাকেজ চালু করা দরকার। দোকানে খুচরা প্যাড বিক্রি, কর্মজীবী নারীদের জন্য অফিসে উপযুক্ত টয়লেট ও ছুটি, এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থায় মাসিক-সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।
বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটির (জিএফএফ) কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর নন্দিনী লোপা বলেন, “মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার মতো টেকসই ও সুলভ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে কেউ এই মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে না থাকে।”
বৈঠকের সঞ্চালক পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক ডা. নূর মোহাম্মদ আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে বলেন,
‘মাসিক নিয়ে আমরা যে কণ্ঠস্বর তৈরি করেছি, এটা ছড়িয়ে দিতে চাই। এটাই আমাদের এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে বোঝাতে হবে যে এটা নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। শিক্ষকদের বলতে হবে, এটা বাসায় নয় শিক্ষার্থীদের সামনেই আলোচনা করতে হবে।’
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু নারীর বিষয় নয়—এটি সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন। তারচেয়ে বড় কথা, মাসিকের মতো প্রাকৃতিক বিষয়কে গোপন রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাই মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারকে নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সমাজকে মাসিকবান্ধব করতে হলে প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাবান দৃষ্টিভঙ্গি। এখন সময়, এই নীরব বিপ্লবকে সবার আলোচনায় নিয়ে আসার।
সূত্রঃ আজকের পত্রিকা